
চীনের উহান থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। তখন সবার ধারণা ছিল, ভাইরাসটি চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে সেটি হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাসটি বিশ্বের সবগুলো রাষ্ট্র ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি রূপ নেয়। এরপর অসংখ্যবার রূপ বদল করে করোনাভাইরাস। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিলিয়ান, ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়্যান্ট উলেখযোগ্য। তবে চলতি বছরের মার্চে শনাক্ত হওয়া ডেল্টা ভেরিয়্যান্ট বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রত্যেকটি দেশ হিমশিম খায়। এর মধ্যে প্রতিষেধক টিকাদান কার্যক্রমও শুরু হয়। গবেষকদের ধারণা ছিল, করোনা থেকে মুক্তি আনবে এই টিকা। অনেকটা আশার আলোও দেখাচ্ছিল টিকা। সংক্রমণ ও মৃত্যুও কমে আসছিল অনেকটা। কিন্তু এর মধ্যেই আফ্রিকায় শনাক্ত হয় করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন। গত ২৪ নভেম্বর আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় শনাক্ত হওয়া ধরনটি এক মাসের ব্যবধানে শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও জিম্বাবুয়েফেরত দুই নারী ক্রিকেটারের শরীরে ওমিক্রণের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর আরও পাঁচজনের শরীরে ওমিক্রন ধরন শনাক্ত হয়েছে। আফ্রিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশে শুরু হয়েছে সামাজিক সংক্রমণ। বিশ্বজুড়ে অপ্রত্যাশিত গতিতে ওমিক্রনের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে উলেখ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবাইকে সতর্ক করেছে। এই ওমিক্রনের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণের আরেকটি ঢেউ আসছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
সুতরাং করোনাভাইরাসের জিনগত রূপ যেভাবে বদল করে একের পর এক ভেরিয়্যান্ট নিয়ে আবিভর্‚ত হচ্ছে তাতে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে, সংক্রমণ কতোটা ভয়াবহ হবে কিংবা আরও কতো মানুষের মৃত্যু ঘটাবে তা অজানা। আবার অনেকে মনে করেন, করোনাকে সঙ্গী করেই করতে হবে জীবনযাপন।
প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, করোনা মহামারি সবচেয়ে খারাপ অংশে প্রবেশ করতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ওমিক্রন আতঙ্ক নিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে নতুন বছর।
অসহায় ছিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা:
করোনাভাইরাস মহামারি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বের শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা থাকা দেশগুলোও ছিল একরকম অসহায়। বাংলাদেশে এটি আরও বেশি করে লক্ষ্য করা গেছে। আগের বছর একের পর কেলেঙ্কারির জš§ দেয় স্বাস্থ্যখাত। ঘটে দুর্নীতির ঘটনাও। বড় বড় পদে ঘটে রদবদল। তবে চলতি বছর করোনার ভারতীয় ডেল্টা ধরন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে একরকম চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। মে মাসের শেষ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণ ও মৃত্যু আতঙ্ক সৃষ্টি করে। মে মাস থেকে প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ হাজার রোগী শনাক্ত এবং পরবর্তীতে প্রতিদিন ১০ হাজারের ওপরে রোগী শনাক্ত এবং দুইশ’র ওপরে মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলেও শয্যা না থাকায় ঘরে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতালে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে ঘুরে রাস্তায় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। সবচেয়ে বেশি সংকট হয় আইসিইউ শয্যা নিয়ে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হয়।
টিকার আশা সংশয়ে রাখল ওমিক্রন:
করোনাভাইরাস মহামারি দূর করতে আশার আলো জাগানো টিকা ওমিক্রন ভেরিয়্যান্টের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকার হবে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষেধক টিকার দুই ডোজ গ্রহণের পর ওমিক্রন লক্ষণযুক্ত সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা শূন্য থেকে ২০ শতাংশ আর বুস্টার ডোজের পর তা ৫৫ থেকে ৮০ শতাংশ হয়। ফের ডেল্টার সংক্রমিত হওয়ার চেয়ে ওমিক্রনে সংক্রমিক হওয়ার আশঙ্কা ৫ দশমিক ৪ গুন বেশি।
রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওমিক্রন সংক্রমণের আগে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপরও একটি গবেষণা করা হয়। এতে দেখা যায়, সার্স-কোভ-২ এর আগের সংক্রমণ ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে দ্বিতীয় সংক্রমণের বিরুদ্ধে ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে সক্ষম। কিন্তু ওমিক্রনের ক্ষেত্রে এ হার ১৯ শতাংশের মতো।
সুতরাং ওমিক্রনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পেতে হলে বুস্টার ডোজে যেতে হবে। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি ও ফ্রন্টলাইনারদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ জনের মতো ব্যক্তিকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। এরপর গত মঙ্গলবার থেকে বুস্টার ডোজের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১ হাজার ৪০৯ জন বুস্টার ডোজের টিকা পেয়েছেন। আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডাটা নামে টিকার হিসাব সংরক্ষণকারী একটি ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট ৫২ দশমিক ৬৪ শতাংশ মানুষ টিকার আওতায় এসেছে। এর মধ্যে দুই ডোজ করে টিকা পেয়েছেন ২৬ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষ। আর এক ডোজ করে টিকা পেয়েছেন ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ মানুষ। সুতরাং টিকাদানে গতি না এলে শঙ্কা থেকেই যাবে।