নিজস্ব প্রতিবেদক :
আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপ-কমিটি থেকে সদ্য পদ হারানো হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তার নামে তিনটি মামলা দায়ের করা হলো। গতকাল শুক্রবার রাতে পল্লবী থানায় র্যাব বাদী হয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন এর ৩৫, ৫৫, ৭৩ ধারায় মামলাটি দায়ের করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, এর আগে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এছাড়া বিশেষ ক্ষমতা আইন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের চারটি ধারায় আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়াই মিরপুরে হেলেনা জাহাঙ্গীর জয়যাত্রা টেলিভিশন স্টেশন পরিচালনা করছিল। র্যাব-৪ এর অভিযানে সেটি সিলগালা করে এবং অবৈধ মালামাল জব্দ করা হয়। হেলেনা জাহাঙ্গীর টেলিভিশনটির কর্মী ও সাংবাদিক নিয়োগের নামে চাঁদাবাজি ও প্রতারণা করতেন। এ ধরনের একটি চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ফোনালাপ ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অভিযানে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত নথিপত্রও জব্দ করা হয়েছে বলে জানান খন্দকার মঈন।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার পর হেলেনা জাহাঙ্গীরের গুলশান-২ এর ৩৬ নম্বর রোডের বাসভবনে অভিযান শুরু করে র?্যাব। দীর্ঘ চার ঘণ্টা অভিযানের পর তাকে আটক করা হয় এবং তার বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদ ও বন্যপ্রাণীর চামড়া জব্দ করা হয়। গুলশান থানায় দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় শুক্রবার হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ শাহানুর আলম মামলার সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রথমে সখ্যতা তৈরি করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেল। এই ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতেন সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর। তাদের কাছ থেকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করা হয়েছে সে বিষয়ে তথ্য আমরা পেয়েছি। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে? বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। আল মঈন বলেন, হেলেনা সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির জন্য থেমে থাকেননি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাকেই প্রয়োজন হয়েছে তাকে তিনি ঘায়েল করেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন এবং সেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছেন শুধুমাত্র উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আমাদের মামলার কারণ এটাই। সে রাষ্ট্রের ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছে যা তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, জনগণের মধ্যেও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে উত্তরা র্যাব সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেন, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন এই মামলাটি র্যাব তদন্ত করবে, তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে আমরা আবেদন করব। তবে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে হবে। হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী ১৯৯০ সাল থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সঙ্গে পার্টনারশিপ’র মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
আমরা জানতে পেরেছি গত দুই বছরে বিভিন্ন মাধ্যম এবং টেলিভিশনে চাকরি দেয়ার কথা বলে, এজেন্সি দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা আদায় করতো। কারও কাছ থেকে দশ হাজার থেকে বিশ হাজার টাকা, আবার কারও কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। কী কারণে টাকা নিয়েছেন এবং কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে- এ বিষয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা। এসবের দায় অফিস স্টাফদের ওপর চাপিয়েছেন তিনি। বাসায় এবং অফিস থেকে যে পরিমাণ ভাউচার পাওয়া গেছে তা এখনও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জয়যাত্রা টেলিভিশন’র আইডি কার্ড ব্যবহার করে অনেক প্রতিনিধিও এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন- হেলেনা জাহাঙ্গীর আমাদেরকে জানিয়েছেন, তার ১৫ থেকে ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তিনি জড়িত। বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করা টাকাগুলো তিনি ফাউন্ডেশনে কাজে লাগাতেন। সুনামগঞ্জে তিনি ত্রাণ বিতরণ করায় স্থানীয়রা তাকে পল্লী মাতা উপাধি দিয়েছেন। ফাউন্ডেশনের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে অনেক টাকা এনেছেন। এগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা গেছে, ফ্ল্যাট কিংবা গাড়ির সংখ্যা কতগুলো সে বিষয়ে প্রকৃত কোনও তথ্য আমাদের দিতে পারেনি। কখনও ৬টি গাড়ি, কখনও ৮ গাড়ির কথা উল্লেখ করেন তিনি। এসব বিষয়ে যারা তদন্ত করবেন তারা খতিয়ে দেখবেন। তার আয়ের উৎস সম্পর্কে সিআইডি কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও মনে করেন র্যাবের এই কর্মকর্তা।
জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর র্যাবকে আরও জানায়, সম্প্রতি তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে সমাজসেবক হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় ছিলেন। বেশ কয়েকবার তিনি নির্বাচন করতে চেয়ে ছিলেন। তিনি শুধুমাত্র নিজের অবস্থান উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এধরনের অপপ্রয়াস অপতৎপরতা চালিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশের মানুষ তাকে চিনবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি বক্তব্য উল্লেখ করে খন্দকার আল আমিন বলেন, বক্তব্য খুবই উদ্বেগজনক। কাউকে এভাবে হেয় প্রতিপন্নভাবে কথা বলা সমীচীন নয়।
তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের উদ্দেশ করে অপপ্রচার এসব বিষয় হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগ। আর আমাদেরও কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল যার প্রেক্ষিতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। আমাদের কাছে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে তার বাসায় অভিযান পরিচালনা করে মাদক, ওয়াকিটকি, চামড়া, ক্যাসিনো সরঞ্জাম উদ্ধার করি। হেলেনা জাহাঙ্গীরের আইপি টিভির জয়যাত্রা কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের মত। যার কোনও বৈধ সম্প্রচারের অনুমোদন ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, শিগগিরই তিনি এটা অনুমোদন পেয়ে যেতেন। অনুমোদন না থাকায় বিটিআরসি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় এবং আমরা মালামাল জব্দ করে মামলা করেছি।
গত শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর কুর্মিটোলায় সদর দপ্ততরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, অপকৌশলের মাধ্যমে ‘মাদার তেরেসা’, ‘পল্লী মাতা’ ও ‘প্রবাসী মাতা’ হিসেবে পরিচিতি পেতে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন হেলেনা। তার পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘবদ্ধ চক্রটি এসব ভুয়া খেতাবের অপপ্রচার চালাত। তিনি বিভিন্ন দেশি সংস্থা ও ব্যক্তি থেকে জয়যাত্রা ফাউন্ডেশনের নামে অর্থ সংগ্রহ করতেন। যা মানবিক সহায়তায় ব্যবহারের চেয়ে নিজের খেতাব প্রচার প্রচারণায় বেশি ব্যবহার করা হতো।