দেশে রপ্তানী মুখী তৈরী পোশাক শিল্প তথা গামেন্টস শিল্প নতুন করে হুমকীর মুখে পড়ার আশংকা সংশ্লিষ্ট মহলের। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম এই সেক্টর হুমকীতে পড়লে কমবে তৈরী পোশাক খাত থেকে রপ্তানী আয়, কমবে এককভাবে মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানী। এর ফলে পোশাকসহ মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রে অন্যান্য রপ্তানী পণ্যেও বিরুপ প্রভাব পড়বে। তখন দেশের শুধু রপ্তানী মুখী পোশাক খাতই নয় যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধসহ অন্যান্য পণ্য রপ্তানীও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনি অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভে, পোশাক খাতে ক্রয়াদেশের অভাবে কর্মসংস্থান সংকোচিত হবে, শ্রমিকরা চাকরি হারাবে। মূলত: সম্প্রতি মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানীতে বিদ্যমান ১৫% শুল্ক হার থেকে এক লাফে বাড়িয়ে ৩৭% শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে এই আশংকা তৈরী হয়েছে। প্রসঙ্গত: বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারসাম্য এখন বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে যত পণ্য আমদানি হয়, এর চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি রপ্তানি হয় সে দেশে। যদিও রপ্তানির সিংহভাগই তৈরি পোশাক। তবে এখনো বাংলাদেশি পণ্যের ওপর গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ রয়েছে। এই ১৫ শতাংশের সঙ্গে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক বাড়তি হিসেবে যুক্ত হবে।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৭-১৮ শতাংশের গন্তব্যও দেশটি। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে পোশাক রপ্তানি ০.৭৩ শতাংশ বেড়ে ৭৩৪ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। এ ছাড়া রপ্তানির পরিমাণও বেড়েছে ৪.৮৬ শতাংশ। মার্কিন পোশাক আমদানির সর্বশেষ তথ্যে এই চিত্র উঠে এসেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দাম ৩.৮ থেকে ৭.৭ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর কারণে রপ্তানি প্রায় ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পরও আশানুরূপ পরিমাণে আয় বাড়েনি।
ইউএস সেনসাস ব্যুরোর হিসাবে, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি প্রায় আড়াই শ কোটি মার্কিন ডলার বেড়েছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানি বেড়েছে সোয়া শ কোটি ডলারের মতো। যে গতিতে দেশের রপ্তানি বেড়েছে, সেই গতিতে আমদানি বাড়েনি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। তাতে গত বছর বাণিজ্য–ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬১৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের পক্ষে আছে। কিন্তু তবুও আমাদের শংখা থেকেই যাবে। এর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে রপ্তানি করেছে ৫৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। এটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ১৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। নভেম্বর মাসেও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছিল ৪১ শতাংশ।
কারণ এমনিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে সম্ভাব্য ধ্বস,স্থানীয় ভাবে দেশে গ্যাস- বিদূতের স্বল্পতা দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি শিল্পখাতে সংকট রয়েছে। বর্তমানে চাহিদার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম গ্যাস পাচ্ছে শিল্পকারখানা। শিল্পের মধ্যে গ্যাসের ব্যবহার পোশাক খাতেই বেশি। এ খাতে গত দুই বছর ধরেই গ্যাস সংকট চলছে। তবে নতুন করে গ্যাস সংকট উৎপাদন কাঠামোকে এলোমেলো করে দিয়েছে । এই অবস্থায় ফেব্রুয়ারি মাসে পোশাক রপ্তানির ক্রয় আদেশ (ইউডি) ৪২ শতাংশ কমেছে, যা গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতন। ফেব্রুয়ারি মাসের অপ্রত্যাশিত এই ধস পোশাক শিল্পের স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকে পুনরায় অনিশ্চয়তার মুখে ফেলছে। এই পরিসংখ্যানে দেশের বিশেষজ্ঞ এবং শিল্পমালিকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
মূলত গত আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এর প্রভাব পড়ছে পোশাক শিল্পেও। তখন ঢাকার আশেপাশের প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলোয় ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। এ অবস্থায় চলে অক্টোবর পর্যন্ত। বিভিন্ন দাবিদাওয়াকে সামনে রেখে আন্দোলন করতে থাকে পোশাক শ্রমিকরা। আর এই শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বন্ধ হতে থাকে কারখানাগুলো। মুখ ঘুরিয়ে নিতে থাকে অনেক বিদেশি ক্রেতা। অস্থিরতার কারণে উল্টো পোশাকশিল্প পড়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং অব্যাহত শ্রমিক অসন্তোষের মতো কারণগুলো এর জন্য দায়ী ছিল। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান পোশাক খাত হুমকিতে পড়লে মালিক-শ্রমিক যেমন বিপদে পড়বে তেমনই সারা দেশের অর্থনীতিও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ শিল্পের বহুমুখীকরণ ও সমৃদ্ধকরণে সরকার, উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটিয়ে কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তথ্য অনুযায়ী গত বছরে তৈরি পোশাক নিটওয়্যার ও টেক্সটাইল শিল্পের ১৪০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে ৯৪ হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছে। তাছাড়া এটি দেশের প্রধানতম বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের খাত হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও ব্যাহত হয়। বলা হয়ে থাকে তৈরি পোশাক শিল্প হচ্ছে ক্রেতাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি একটি ব্যবসায়িক সম্পর্কের ফল। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যে সুনাম অর্জন করেছে এবং বিশ্বের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে, এটা মূলত বিগত তিন দশকের ফল।
তদুপরি এই সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বহুদিন ধরেই সক্রিয়। আগস্টে সরকার পতনের পর সৃষ্ট আন্দোলনেও এই ষড়যন্ত্রকারীরা ইন্ধন দেয়। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বিশৃঙ্খলা, হামলা-ভাঙচুর চালিয়ে শিল্পকে বিপর্যস্ত করে লাখ লাখ শ্রমিকের কর্মপরিধি সংকুচিত করাটাই ছিল তাদের লক্ষ্য। আর এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারে ভাগ বসাতে চায়। এর কারণ হচ্ছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পোশাকপণ্যের খ্যাতি যে উচ্চতায় পৌঁছে গেছে তা অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও কম্বোডিয়ার পোশাক পণ্য পৌঁছাতে পারেনি। তাছাড়া পোশাকশিল্পে দীর্ঘ সময় ধরে বৈশ্বিক বাজারে শীর্ষ থাকা চীনের পর দ্বিতীয় অবস্থানই বাংলাদেশের। ফলে দেশি-বিদেশি অপশক্তি, যারা বাংলাদেশের বাজার ধরতে চায় তারা বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলে। তাদের বোঝানো হয়, বাংলাদেশের শ্রমিকরা শোষিত, তাদের ঠকানো হচ্ছে। নিজেদের অধিকার তাদের নিজেদেরই আদায় করতে হবে। এই কারণে শিল্প মালিকদের গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বারবার বলতে শোনা গেছে, ‘একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এই শিল্পকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিতে শ্রমিক অসন্তোষের পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে।’ বাংলাদেশে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির মাধ্যমে পোশাকশিল্প কারখানা বন্ধ রাখা গেলে নিশ্চিতভাবেই অনেক ক্রয়াদেশ এখান থেকে অন্য দেশে চলে যাবে। আর এসব ক্রয়াদেশ স্বভাবতই প্রতিযোগী দেশগুলোই পাবে।
তবে আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বে পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনার শীর্ষে থাকা অর্ধেকই বাংলাদেশের পোশাক কারখানা। বিজিএমইএ’র তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে বর্তমানে লিড সনদ পাওয়া পরিবেশবান্ধব কারখানা রয়েছে ২১৮। তার মধ্যে লিড প্লাটিনাম সনদধারী ৮৪টি, গোল্ড ১২০টি, সিলভার ১০টি ও ৪টি কারখানা সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। এর পাশাপাশি, বিশ্বের ১০০টি পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার মধ্যে ৫৬টি অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কারখানা বাংলাদেশের। এসব অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বজুড়ে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ফলে ‘মেড ইন বাংলাদেশ লেখা’ পোশাক সারা বিশ্বের নামিদামি ফ্যাশন হাউজগুলোতে বহু আগে থেকে স্থান করে নিয়েছে। এখন পর্যন্ত সেই অবস্থান বাংলাদেশ ধরে রেখেছে অত্যন্ত সুনাম ও গৌরবের সাথে। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের অগ্রযাত্রা প্রায় চার দশকের। তবে প্রথম দিকে অপরিকল্পিত ভাবে কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। তখন কাজের মান নিয়েও অনেক প্রশ্ন ছিল। তাছাড়া, শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তা, পৃথক গার্মেন্টেস ভিলেজ এবং প্রযুক্তি উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। তবে রানা-প্লাজা ট্র্যাজেডির পর তৎকালীন সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র খাত। এর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন হলো পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস এর জনপ্রিয়তা ও বৈশি^ক ইমেজকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার (জিএসপি) সুবিধা পুনরুদ্ধারসহ ইউরোপে অব্যাহত শুল্কমুক্ত পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ আলোচনার ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এই এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে পোশাকশিল্পের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে । কারণ, ক্রেতারা তাদের সোর্সিং গন্তব্য ঠিক করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টির ওপরে গুরুত্ব দেন, তা হলো দেশের ও শিল্পের স্থিতিশীলতা।
এনে রাখতে হবে, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এই খাত হুমকিতে পড়লে মালিক-শ্রমিক যেমন বিপদে পড়বে তেমনি দেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এ শিল্পের বাজার সম্প্রসারণ ,পোশাকে বৈচিত্র আনা, আরো টেকসই করা, বহুমুখীকরণ ও সমৃদ্ধকরণে সরকার, উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটিয়ে কৌশলগত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা,কারখানাসমূহের আভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা,কর্মীবান্ধব পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য্য। একই সঙ্গে নতুন করে আরোপিত ৩৭% শুল্ককর আগের ১৫% এ বলবত রাখতে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ধারবাহিক আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই সম্ভব পোশাকসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের অবাধ প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখা যাবে।
মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক - বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম ।