বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা,ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে বাংলাদেশসহ বিশ^ব্যাপী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষকায় মানুষের জীবন ব্যবস্থা, জীবন যাপন,জীবনাচারেও এসেছে পরিবর্তন।এরই ধারবাহিকতায় এআই এবং রোবটিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে মানুষের দৈনন্দিন নানা কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে মানুষের কাজ কর্মকে অনেকাংশে যেমনি সহজ ও গতিময়তা এনেছে , তেমনি মানুষের চাহিদা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও এসেছে। লেখক ‘ যাযাবরের মতে,‘ বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ (গতি) , কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’কারণ বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ হাল জামানায় কথা বার্তা, ভাব আদান প্রদান, তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে চিঠি পত্রের পরিবর্তে মোবাইলসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এসব সম্পন্ন করছে।
এর ফলে মানবিকতা,আবেগ,অনুভূতি,আন্তরিকতা,সামাজিকতা,লৌকিকতা ক্রমেই বিলোপ হচ্ছে। এর ঢেউ লেগেছে ব্যক্তি,পারিবারিক,সামাজিক,ধর্মীয়,সামাজিক অনুষ্ঠান এমন কি রাষ্ট্রাচারেও। এ কারণে আগের জামানার ঈদ, বিয়ে সাদি,সুন্নতে খাতনা,জন্ম-মৃত্যু, পূজা পার্বনের উৎসব আয়োজনের সাথে সাম্প্রতিক সময়ের উৎসব আয়োজনের মধ্যে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন এবং বৈচিত্র। সমাজ গবেষকদের মতে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এই পরির্বতনের ইতিবাচক দিক যেমন আছে তেমনি নৈতিবাচক দিকও আছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সুযোগ ব্যবহার করে মানুষ কম সময়ে দ্রুততার সঙ্গে বহু কাজ সম্পন্ন করতে পারছে। আর নেতিবাচক দিক হচ্ছে,মানুষ যন্ত্র নির্ভর হওয়ায় মানুষের মধ্যে মানবিকতা,সামাজিকতা,লৌকিকতা,আন্তরিকতা লোপ পাচ্ছ। একটি কল্যাণকর ও মানবিক সমাজের জন্য এটা কাম্য হতে পারেনা। সদ্য অনুষ্ঠিত মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে উপরোক্ত কথা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে।
ছোটবেলা থেকে দেখেছি ঈদের নামাজের আয়োজন হয় খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত মাঠে। একেবারেই বৈরী আবহাওয়ার কারণে মসজিদে ঈদের নামাজ হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় খোলা মাঠেই ঈদের নামাজের আয়োজন হয়। ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে নানারকম মেলা বসতে দেখেছি। এখন অবশ্য দেশেও আর সেভাবে মেলার আয়োজন হয় না। কেননা মেলার ধারণা এবং প্রয়োজনীয়তা, দুটোই আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও যখন ঈদ অনুষ্ঠিত হয়েছে গরমের দিনে, শীতের দিনে তখন খোলা মাঠেই ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেখানে আকর্ষণীয় মেলার আয়োজনও হতো। সেই মেলায় নানারকম আকর্ষণীয় দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি হতো। অবশ্য বৃষ্টির মৌসুমে উন্মুক্ত মাঠের পরিবর্তে মসজিদে আদায়ের আয়োজন করা হলে তার আশ পাশে ছাতা ,সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দোকানপাট বসানো হতো। এ থেকে নামাজের জন্য আগত মুসল্লিদের সঙ্গে তাদের সন্তানরাও এসে নামাজে অংশগ্রহণ শেষে উৎসাহ নিয়ে খেলনা,বিভিন্ন রকম খাওয়ার,আইসক্রিম ক্রয় করতো। মূলত: এসবের মধ্যদিয়েই ঈদ আনন্দ উপভোগ করতো শিশু কিশোরা। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তির এই সময়ে শিশু কিশোর এর পরিবর্তে মোবাইলে গেম খেলে, চ্যাটিং করে সময় কাটাতে ব্যস্ত থাকে।
ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দের সঙ্গে থাকে অর্থযোগও। ঈদউল ফিতর এর মধ্য দিয়ে শুধু যে একটি পবিত্র মাসের অবসান হয় তা নয়। আনন্দ, ভ্রাতৃত্ব ও উদারতার এক অনন্য নজির সৃষ্টি হয় ঈদে। ঈদকে কেন্দ্র করে রোজার পুরো মাসব্যাপী কেনাকাটিতে অর্থনীতিকে চাঙ্গা এবং গতিশীল করে। কাজেই শুধু ঈদ নয় যে কোন উৎসবে দেশের অর্থনীতিতে অর্থের ব্যাপক প্রবাহ সৃষ্টি হয়। কারণ ধনী,গরীব,মধ্যবিত্ত,নিন্ম মধ্যবিত্তি নির্বিশেষে সকলেই তাদের সামর্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী পরিবার পরিজনের জন্য ,তাদের প্রিয়জনদের জন্য কাপড় ছোপড়,কসমেটিকস,টুপি,জুতা,আতর কিনে উপহার দেয়। এর ফলে এই সময়টায় দেশের অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাব ফিরে আসে।
বেসরকারি হিসাবে, ‘ফিতরা’ দেয়া হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য ফিতরা বাধ্যতামূলক। সাধারণত ঈদ উদযাপনে মানুষ যখন শহর থেকে গ্রামে আসেন তখন তারা তুলনামূলক দরিদ্রদের ‘ফিতরা’ দেন। যাকাত বাবত ধনীরা তাদের অর্জিত,গচ্ছিত সম্পদ থেকে নির্ধারিত পরিমান অর্থ গরীব অভাবী মানুষের মধ্যে বিলি বন্ঠন করায় সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগৌষ্ঠি যথেষ্ট উপকৃত হয়। তাছাড়া ঈদের সময় দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। কারণ প্রবাসীরা দেশে থাকা তাদের স্বজন,প্রিয়জনদের জন্য টাকা পাঠান যাতে তাদের পরিবারের সদস্যরা স্বাচ্ছন্দে ঈদ উদযাপন করতে পারেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি মার্চের প্রথম ২৬ দিনে রেকর্ড দুই দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। অবশ্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার রেমিটেন্স এসেছে ৮২ শতাংশ বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপক মনে করেন, দেশে রেমিটেন্স আসা এবং শহরের মানুষ ঈদে তাদের গ্রাসে যাওয়ার মধ্যদিয়ে এর মাধ্যমে সম্পদের স্থানান্তর এবং পুনর্বণ্টন হয়। এর ফলে গ্রাম-গঞ্জ-শহরের বাজারগুলোয় ঈদের কেনাকাটার ধুম পড়ে। সব পেশার মানুষ উৎসবের কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। দোকানিরাও ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে নানান পণ্যের পসরা সাজান।
অন্যদিকে এবারের পবিত্র রমজান মাস পুরোটা সময় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিন্মমুখী এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্থিতিশীল থাকায় ন্মি আয়ের মানুষ,মধ্যবিত্তসহ সকল শ্রেনীর মানুষের মধ্যে স্বস্তি ছিল। এ জন্য ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নের্তৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার রোজায় সব রকম ভোগ্যপণ্য মূল্য সহনীয় এবং স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ বিশেষ করে প্রতিটি পণ্যের আমদানি, সরবরাহ,মজুত, বাজার দর যথাযথ বাস্তবায়নে নিয়মিত মনিটরিং ,তদারকি অব্যাহত রাখায় মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে সহনীয় দামে প্রতিটি পণ্য ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য এর কৃতিত্ব অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্ঠা ড.মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাণিজ্য উপদেষ্ঠার শেখ বসির উদ্দিন ও তাঁর অধীনস্থ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থাসমূহের। দেশের মানুষের প্রত্যাশা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মূল্য বছর ব্যাপী সহনীয় রাখতে অন্তবর্তী সরকার এবং এই সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্ঠা শেখ বসির উদ্দিন কার্যকর পদক্ষেপ অব্যাহত রাখবেন। ভোক্তাদের অভিমত সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া, সড়ক ও বাজার পরিস্থিতি মনিটর, সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা, এসব উদ্যোগ জনগণকে স্বস্তির মধ্যে রেখেছে। রমজানজুড়ে বাজার পরিস্থিতি ছিল বিগত বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখ করার মতো। এবারের রজমানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষের মধ্যে হাহাকার ছিল না। রমজানের আগে থেকে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা, শীতের সবজির উৎপাদন বৃদ্ধির সময়ে রমজান চলে আসা, অতি মুনাফার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার মতো বিষয়গুলো রমজানে স্বস্তি দিয়েছে। যদিও কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দাম নিয়ে কিছু অস্বস্তি ছিল।
এবারের ঈদে সড়ক, রেলপথ এবং নৌপথে যাত্রা পরিস্থিতি অনেক স্বস্তি ছিল। দীর্ঘ ছুটিতে পর্যায়ক্রমে মানুষের বাড়ি ফেরা, বৃষ্টি না থাকায় সড়কে যান চলাচল ঠিক থাকার মতো বিষয়গুলো ঈদযাত্রায় স্বস্তি দিয়েছে। পাশাপাশি সড়ক মনিটরিং কার্যক্রম স্বস্তির মাত্রা বাড়িয়েছে। কোথাও কোথাও সেনা বাহিনীর সদস্যরা সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করায় আরও স্বস্তি মিলেছে সড়কে। আর ট্রেনে ঈদযাত্রাও দীর্ঘ ছুটির কারণে মানুষ স্বস্তিতে বাড়ি ফিরেছেন। ট্রেনের সিডিউলও ঠিক ছিল। বিপুল সংখ্যক মানুষ নৌপথে বাড়ি ফিরলেও তাদের তেমন বিড়ম্বনা ছিল না।
দৃশ্যনীয় এবারের ঈদের কেনাকাটায় ছিল মানুষের স্বস্তি, ঘরমুখো লাখো মানুষের সড়কে রেলপথে ও নৌপথে নিরাপদ ও স্বস্তির যাত্রা, ঈদের দিনও কেটেছে আনন্দ-উৎসবে। সব মিলিয়ে এবার অন্যরকম এক স্বস্তির ঈদ পার করেছেন দেশবাসী। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ঠা মেজর জেনারেল ( অব:)জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পুরো রমজান মাস জুড়ে বিভিন্ন থানা,লঞ্চ টার্মিনাল, রেল ষ্টেশন এবং বাসটার্মিনাল আকষ্কিক পরিদর্শন করেছেন। এসময় মাঠে দায়িত ¡পালনরত পুলিশ,র্যাব,আনসার,গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে সাহস ও শক্তিযোগাতে অনুপ্রেরনা যুগিয়েছেন,উৎসাহ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ঠা।পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে পুলিশকে সহযোগিতা করার জন্য জগনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। এছাড়াও দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে বেসরকারি প্রশাসনকে সহযোগিতা দিতে মাঠ পর্যায়ে সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালন করছে আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। বিচ্ছিন্ন এবং অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনা ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা নিয়ান্ত্রণে গৃহীত এসব পদক্ষেপের কারণে মানুষ নির্ভয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে অতিবাহিত করেছে বিগত রমজান মাস। আগামী দিনগুলো শান্তপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত করতে পারবে সেই প্রত্যাশা মানুষের।
বাঙালি জাতি এক সৌহার্দ্যের সম্প্রীতি এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিকশিত হোক এটিই সকলে প্রত্যাশা করে। বাঙালি সংঘাত চায় না, বাঙালি শান্তি চায়, বাঙালি জাতি তার বিকাশ চায়। বাঙালি জাতি প্রাণ খুলে হাসতে চায়। আর সেই হাসি আনন্দের এক সাম্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণই হোক আমাদের লক্ষ্য। আর সেজন্য আমাদের সবার হৃদয়ে ধারণ করতে হবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনাকে ।
প্রসঙ্গত: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে নানা শ্রেণি-পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়কালে বলেছেন, ‘আজকের দিনকে আমরা প্রতিদিন স্মরণ করি। আমরা দেশে শান্তি চাই, যাতে মানুষ নিজ মনে নিজের আগ্রহে চলতে পারে। কারো ভয়ে, ভীত হয়ে তাকে চলতে না হয়। আমরা সবাই সবার মঙ্গল কামনা করি। আমরা জাতির জন্য শান্তি চাই এবং সারা পৃথিবীর জন্য শান্তি চাই।’ তঁ^ার এই আশাবাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই একজন বাঙ্গালী হিসেবে বাংলাদেশের ,দেশের মানুষের শান্তি,মঙ্গল,কল্যাণ,উন্নয়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিবেদিত ভাবে নিরন্তর কাজ করলেই প্রত্যাশা পূরণ সম্ভব। একই সঙ্গে বৈশি^ক নাগরিক হিসেবে পুরো বিশে^র শান্তি প্রতিষ্ঠায় সোচ্ছার হওয়া সকলের নৈতিক দায়িত্ব।
মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক,সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।