সেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। থাকতাম পুরান ঢাকার লুৎফর রহমান লেন এর সুরিটোলাতে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু শামসুদ্দিনদের এর বাড়িতে। বংশালের হাজী আব্দুল্লাহ সরকার লেনের বাসা থেকে শামসুদ্দিনদের ভাড়া বাসায় উঠেছি। আমরা সম্ভবত নয়/দশ মাস এ বাড়িতে থেকেছি। এরপর আবার দেশ স্বাধীনের দেড়/দু’মাস আগেই বংশালের বাসাতে চলে যাই। সামসুদ্দিনের বাবা ছিলেন একজন রিকসা ব্যবসায়ী। আলুর বাজারে তাঁর রিকসা গ্যারেজ ছিলো। তাঁর স্ত্রী ছিলেন, নাজিরা বাজার বাংলা দুয়ারের রিকসা নির্মাতা ফকির চাঁনের বড় বোন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন, অত্যন্ত হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছল, প্রাণবন্ত একটি দম্পতি। বংশালের বাড়িতেই ছিল আমাদের শৈশব, কৈশোর, লেখাপড়া, সবকিছু। যাকগে সে-সব কথা। ১৯৭১ এর ভয়াল ২৫ মার্চ তারিখে গণহত্যার কালরাত্রিতে আমি, বাবা, মা, ভাই-বোন সহ সামসুদ্দিনদের বাড়িতে ছিলাম। ঐ দিন রাত সাড়ে এগারোটায় অপারেশন সার্চ লাইট নামে পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রসহ ঢাকার নিরীহ, নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের উপর পূর্বের নীলনকশা অনুযায়ী ইতিহাসের-নৃশংসতম বর্বরোচিত গণহত্যায় অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাত্রে ঘুমাবার আগে ভুলেও টের পাইনি এমন বর্বরোচিত হামলার কথা। সামান্য টের পেলেও বাড়ির মুরুব্বিগণ কর্তৃক নিঃসন্দেহে নির্ঘুম রাত কাটাবার শতভাগ সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। ওরা নিরীহ জনসাধারণের উপর অতর্কিতে বর্বোরোচিত হামলা চালানোয় সেদিন বাঙালিকে দেখতে হয়েছে এক বিভীষিকাময় কালরাত্রি। বিশ্ব যুদ্ধের পর এই গণহত্যার নৃশংসতা, বিশ্ব আর দেখেনি। বরাবরই আমার ঘুম ছিলো গাঢ়। ঐ রাত্রেও আমার ঘুমটি গাঢ় হওয়ার কারণে পারিবারিক সদস্যসহ এলাকাবাসীর ভয়ার্ত মুখগুলো দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। অন্যান্য দিনের তুলনায় ঐ দিন বাবা-মা, ভাই-বোনের ঠেলাঠেলিতে খুব ভোরে উঠতে হয়েছিলো। উঠে শুনলাম রাত্রে ঘটে যাওয়া অনেক ভয়াবহ ঘটনা। ঘটনার ভয়াবহতায় শরীর, মন যেনো কেমন অবশ হয়ে আসছিলো।
আমার গায়ের উপর দিয়েই নাকি দা, কুড়াল, ছুরি, খুন্তি, লাঠি-সোঠা যার যা কিছু ছিলো তা নিয়ে সামসুদ্দিনদের বাড়ির ছাদে পাকিস্তানি শত্র“দের মোকাবেলা করার জন্য বাড়ির সকল সদস্যসহ এলাকার মানুষজন জড়ো হয়েছিলো। যার বিন্দুমাত্র আমি টের পাইনি। বর্তমানের ভয়াবহ অবস্থা কোনদিকে যেতে পারে, সকালবেলা তা নিয়ে যখন আলোচনায় সবাই ব্যস্ত। তখন আমি ব্যস্ত বাহিরের অবস্থা কি হয়েছে, তা দেখতে। কচি বয়সে কৌতূহলী মনকে স্থির রাখতে না পেরে বাবা-মা’র জোরালো নিষেধ থাকা সত্বেও বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বাসা থেকে বের হয়ে যখন সুরিটোলা পুকুর পাড় দিয়ে ডানের লুৎফর রহমান লেনে যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম বেশ কয়েকজন লোক পুকুরের বাউন্ডারি ওয়ালে ডেলান দিয়ে অস্পষ্ট শব্দে আলোচনায় ব্যস্ত। উল্লেখ্য পরবর্তীতে বর্ণিত পুকুরটি ভরাট করে বর্তমানে গড়ে ওঠা পুরান ঢাকার নর্থ-সাউথ রোডের সুরিটোলা সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়টি নির্মাণ করা হয়। ভীরু ভীরু পায়ে এগুতে এগুতে পৌঁছলাম নবাবপুর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে (মানসি সিনেমা হল সংলগ্ন)। দেখলাম নবাবপুর পুলিশ ফাঁড়ি ও এর বিপরীত দিকে থাকা ‘সংবাদ’ পত্রিকা অফিসের রাস্তায় রক্তের বন্যায় সৃষ্টি হয়েছে মানচিত্রের ন্যায় অসংখ্য চিত্রকর্ম। পুলিশ ফাঁড়িতে পড়ে থাকা বেশ ক’জন পুলিশ সদস্যের প্রাণহীন দেহ প্রত্যক্ষ করলাম। তাঁদেরই উত্তপ্ত রক্তে সয়লাব হয়ে ফাঁড়ির ফ্লোর সহ রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে আমাদের প্রত্যাশিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একটি আগামীর মানচিত্র, যা দেখে আমার কচি মনে সেদিন ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটি মনে-প্রাণে জাগ্রত হয়ে আমাকে করেছিলো উদ্বেলিত। নবাবপুর ফাঁড়ির রাস্তা থেকে মানসি (পূর্বের নিশাত) সিনেমা হলের দিকে এগিয়ে যেতে রাস্তার বাম পাশে থাকা রেস্টুরেন্টের দিকে দৃষ্টি যাওয়ায় লক্ষ্য করলাম শুনশান নীরবতা। যেখানে গভীর রাত্র পর্যন্ত রেস্টুরেন্টে আসা-যাওয়া লোকজনদের উপস্থিতিতে সরগরম থাকতো পুরো এলাকা। আর তখন ছিলো ভয়ানক নীরবতা। তাদের মনোরঞ্জনের জন্য গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজানো হতো পুরানো দিনের বিখ্যাত ছায়াছবির জনপ্রিয় গানগুলো। তা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ সময়ে উচ্চ ভলিউমে বাজানো হতো বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের সেই যুগান্তকারী ভাষণ। হঠাৎ সেই রেস্টুরেন্টের তছনছ অবস্থা দেখে যখন আরেকটু সামনে অর্থাৎ নবাবপুর রাস্তার দিকে এগুলাম, তখনই নজর গেলো ডাস্টবিনের দিকে। সম্পূর্ণ ডাস্টবিনটি রেকর্ড ভাঙ্গার টুকরো দিয়ে ভর্তি। পাশে থাকা দু’একজন বলাবলি করছে, পাক বাহিনীর বর্বর লোকগুলি নাকি শেখ সাহেবের ভাষণ মনে করে আশেপাশের সবগুলো রেস্টুরেন্টকে নির্দয়ভাবে ভাঙচুর সহ রেকর্ডগুলির এ চরম অবস্থা করেছে। পাক বাহিনীর এমন নির্দয়, নিষ্ঠুর, বর্বরোচিত কর্মকান্ডগুলি আমার কচি মনকে যথেষ্ট ব্যথিত করেছিলো। এই ক্ষত-বিক্ষত ব্যথিত মনে আমি আস্তে আস্তে পিছনে এসে অতি সন্তর্পনে মালিটোলা, বংশাল, লেডি পার্ক, ফ্রেঞ্চ রোড, ইংলিশ রোড, তাঁতি বাজার হয়ে শাঁখারী বাজারের প্রবেশমুখে পানিটোলায় গিয়ে দেখলাম চরম ভয়াবহ অবস্থা। যা ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ। এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় এর পুরো অবয়বটি পাকিস্তানি বাহিনীর শ্যেন নজরে পড়ে রাস্তা-ঘাট সব তছনছ হয়ে গেছে। সরু রাস্তায় হাঁটার কোন উপায় নেই। হিন্দু বাড়ির পানি রাখার মটকা ভাঙ্গা, লেপ, তোষক, বালিশ, কাঁথা, চাদর, জামা-কাপড়ের স্তুপে মূল রাস্তা হয়ে গেছে তিন-চারফুট উঁচু। এমতাবস্থায় কৌতূহলী মন পাক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ দেখার জন্য আরো এগুতে যখন তাগিদ দিচ্ছিলো, তখন বাধ্য হয়েই হিন্দু দু’একটি বাড়ির সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। হিন্দুদের মটকায় সংরক্ষিত পানিকে হানাদার বাহিনী কর্তৃক রাস্তায় লেপ-তোষক, কাঁথা, বালিশে ফেলে দেয়ার কারণে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে আছে। যেখানেই পা ফেলি নরম, তোষক, বালিশ ও কাঁথার স্তুপে পচ পচ শব্দে অনেকখানি পা ঢুকে যায়। এভাবে দু’একটি বাসার সামনে গিয়ে দেখলাম, মানুষ মরে গেলে আমরা যে কঙ্কাল রূপ দেখতে পাই তা একদিনের ব্যবধানে পানিটোলা সহ অত্র এলাকার সবগুলো বাড়ির রূপ এমনই হয়েছে। বাড়ির দরজা, জানালা, চৌকাঠ একটিও পুরো আকৃতিতে নেই। এরকমটি হওয়ারতো কথা ছিলোনা। শত্র“ হলে হবে বাড়ির মানুষগুলো। বাড়ির দরজা, জানালা ও চৌকাঠ কি দোষ করলো? পরে যা জানলাম তা শুনে বিস্মিত হলাম। হিন্দু বসবাসকারীরা নাকি সোনা-দানা, টাকা-পয়সা এগুলো চোর-ডাকাতদের ভয়ে দরজা, জানালা চৌকাঠ, লেপ-তোষক, কাঁথা, বালিশের বিভিন্ন সুবিধাজনক জায়গায় লুকিয়ে রাখতো। এটা জেনেই পাক বাহিনীর লোভী সদস্যগণ আমাদেরই কিছু নীতি-নৈতিকতা বিরোধী উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের সহযোগিতায় (স্বাধীনতা বিরোধী, সম্ভবত এরাই পরবর্তীতে রাজাকার, আল- বদর, আল-শামস রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন) তন্নতন্ন করে পোস্ট মর্টেম করেছে প্রতিটি জিনিসে। এ কারণেই নাকি বাড়িগুলোর এমন ভঙ্গুর ও বিভৎস রূপ। দূর থেকে আসা পোড়া গন্ধের তীব্রতায় দম যখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম তখনই ত্বরিত উক্ত এলাকা ত্যাগ করি। পরে চলার পথে আমারই মতো অতি উৎসাহী দু’জন বালকের মাধ্যমে জানতে পারলাম কোর্ট হাউস স্ট্রীট ও শাঁখারি বাজারের প্রবেশমুখে নাকি বেশ কয়েকটি বাসাবাড়িতে দেয়া আগুনের এই পোড়া গন্ধ।
আসার পথে লক্ষ্য করলাম যানবাহনমুক্ত বেশীর ভাগ রাস্তাই ছিলো শুনশান ফাঁকা। গলির ভিতরে দেখা গেছে লোকজনের ভয়ার্ত চাহনি ও চাপা কথাবার্তা। কিছু দূর পর পর ছিলো একসঙ্গে আট/দশজন লোকের জটলা। সবার মধ্যেই ছিলো কুঁকড়ে থাকা দেহে ফিসফসানি কণ্ঠে আলাপরত ভয়ার্ত অবয়ব। এভাবেই আমি সুরিটোলার বাসায় আসার সময় বংশাল-মালিটোলার পুলের উপর এসে যখন দাঁড়ালাম তখন ডানদিকে দেখলাম ডাব বিক্রেতার কিছু ডাব স্তুপাকারে চটের বস্তা দিয়ে ঢাকা। পুলের উপর থেকে দক্ষিণ দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম খালের কালো নোংরা পানিগুলো বিভিন্ন আবর্জনায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অল্প শব্দে প্রবাহিত হচ্ছে। দু’দিকে থাকা ঝুলন্ত টয়লেটগুলোর বিভৎসতা জঘন্যভাবে ফুটে উঠেছে। বংশাল-মালিটোলার খালপাড়ের নীচু জায়গা অর্থাৎ স্থানীয় ভাষায় যাকে নামা বলা হয়। সেই নামায় থাকা সেন্ডেল কারখানার কাটপিসে উঁচুনিচু হয়ে তৈরি হয়েছে ঢেউ সদৃশ রাস্তা। ডাবের অর্ধাংশগুলি পুলের নীচে পড়ে ছোটোখাটো টিলার রূপ নিয়ে পানি প্রবাহের রাস্তটুকুকে করেছে সরু। পুলের বামদিকে অর্থাৎ নাজির বাজার, বাংলাদুয়ার ও ডানদিকে থাকা লুৎফর রহমান লেনের দিকে বেশ কিছু ভরাট করা সরকারি জায়গায় বেড়ার তৈরি ছোট খাটো কিছু দোকান ঘর চোখে পড়লো। এখানে উল্লেখ্য পুলে দাঁড়িয়ে যে বর্ণনাগুলো দেয়া হলো তা বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহু মূল্যবান একটি সড়ক। গুলিস্তান থেকে ইংলিশ রোড পর্যন্ত থাকা ঐ খালটিই পরবর্তীতে ভরাট করে তৈরী করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি, যার নামকরণ করা হয়েছে নর্থ-সাউথ রোড।
রাস্তার দু’ধারে রড, শীট, এঙ্গেল সহ বিভিন্ন ব্যাংক, অফিস, হোটেল ইত্যাদির দোকান। বোকার মতো দঁড়িয়ে এতোক্ষণ অবলোকন করছিলাম, কয়েকটি মহল্লার সংযোগস্থলের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা খালটি। হঠাৎ পাক আর্মির গাড়ী সহ সাইরেনের শব্দে সম্বিৎ ফিরে আসে। তারাহুরো করে একটি গলির ভিতর গিয়ে নিজেকে লুকাই। সঙ্গে কোত্থেকে আরও দু’একজনও দৌড়ে এসে আমার সাথী হন। তাদের সঙ্গে আলোচনায় জানতে পারি গতরাতে অর্থাৎ ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের রাতেই সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। এটা শুনে আমার অন্তর কেঁপে উঠে। কারফিউ শব্দের মানে কি, তাও জানিনা। ওদের বলার ঢংয়ে বুঝেছি খারাপ কিছু। পরে জেনেছি এটাকে সান্ধ্যআইন বলা হয়। এটা বলবৎ থাকাবস্থায় কোনো মানুষ ঘর থেকে বেরুতে পারবে না। আমিতো আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে সুস্থ দেহে নিরাপদে অনেক কিছু দেখে আসলাম। পথিমধ্যে কোনো পাক আর্মির গাড়ি নজরে আসেনি। নজরে আসলে হয়তো আমার অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। যাক রাব্বুল আলামিনের অশেষ কৃপায় ঐ যাত্রায় রক্ষা পেয়ে এখনো অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে আছি। আমার সঙ্গে থাকা দু’জনার পরামর্শে মূল রাস্তায় না এসে বিভিন্ন অলিগলির সাহায্যে সুরিটোলার বাসায় এসে পৌঁছাই। বাসায় এসে দেখি গুমোট একটা ভাব। আমার অনুপস্থিতিতে তাদের সবারই চোখেমুখে ছিলো উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার ছাপ। ইতোমধ্যেই বেতার মারফত কারফিউ সহ পাক বাহিনীর সকল তৎপরতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে আমার ব্যাপারে ছিলো তাঁরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। এখানে উল্লেখ্য যে যেহেতু তখন তথ্য প্রযুক্তির যুগ ছিলো না এবং বেশীর ভাগ প্রিন্ট মিডিয়া ছিলো হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্দেশিত, তাই সত্য সংবাদ শোনা থেকে আমরা ছিলাম ভীষণভাবে বঞ্চিত। ২৫ মার্চের বিস্তারিত নির্ভরযোগ্য সংবাদ আমরা জানতে পেরেছি ২৭ মার্চে ভারতীয় সহ বেশ কয়েকটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যম থেকে।
বন্ধু শামসুদ্দিনের বাবা আব্দুল লতিফ খালুতো আমাকে দেখে বলেই ফেললেন, “আরে মিয়া কই গেছিলা, রাস্তা-ঘাটের অবস্থাতো বহুত খারাপ, এরমধ্যে তুমি গিয়া তোমার বাপ-মায়রে সহ আমাগো বহুত টেনশনে ফালায়া দিছো। অবস্থা বালা না অইলে ভুলেও আর রাস্তায় বাইর অইয়োনা। শামসুদ্দিনের লগে উপ্ রে গিয়া কথাবার্তা কও।”
সামসুদ্দিনের বাবা ও মা’কে আমরা ভাই-বোন সবাই খালাম্মা-খালু বলতাম। দেখলাম এলাকার ৩/৪ জন গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে বাবা-লতিফ খালু রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনাটির শুরু যেভাবে তা টেলিফোনের মাধ্যমে বিশ্বস্তসূত্রে কিছুটা জানতে পেরেছেন। আমি নাস্তা খাওয়ার অজুহাতে ঘটনাটি শুনে যা বুঝলাম, তা হলোঃ- ২৫ মার্চ কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ছিলেন প্রায় হাজার খানেক পুলিশ সদস্য। পাক সেনারা রাত ১১/১১.৩০ টার দিকে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে ছুড়তে নাকি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভিতরে প্রবেশ করে। তখন বাঙালি পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ওদের পাল্টাপাল্টি গুলি বিনিময় হয়। এতে নাকি অনেক পুলিশ সদস্য মারা যান, বেশীর ভাগ পুলিশ সদস্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং কিছু সদস্য আটক হন। পরে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি ঐদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রাণ হারান প্রায় ১৭০ জন পুলিশ সদস্য। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সর্বোচ্চ অস্ত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে আধুনিক সমরাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। পাক হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্রের আঘাতে রাজারবাগের সবকটি ব্যারাক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিলো । অগণিত পুলিশ সদস্য মুখোমুখি লড়াই করে অকাতরে জীবন দান করেছিলেন। এ রাজারবাগ থেকেই শুরু হয় পাক বাহিনীর প্রাণঘাতি, নিষ্ঠুরতম, জঘণ্যতম, অমানবিক, রক্তক্ষয়ী, বর্বোরোচিত, নৃশংসতম হামলার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। তারপরই ছড়িয়ে পড়ে পুরোদেশে। এ দিনে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বাঙালিকে পাকস্তানী হানাদার বাহিনী অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে বলে আমরা বিভিন্নভাবে জেনেছি।
পরে আরও বিস্তারিতভাবে জানলামঃ-
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, রাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বহর নিয়ে ঢাকার রাজপথে স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে নিধন করার অভিপ্রায়ে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহতম গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানার ইপিআর ব্যারাক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, সকল পুলিশ ফাঁড়ি, কমলাপুর রেল স্টেশন, সদরঘাট টার্মিনাল, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা ও পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। নারায়ণগঞ্জ নিবাসী কামরুল আমান, ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘‘কারফিউ চলছিল, তা শিথিল হতেই রওনা হই ঢাকার দিকে। মাতুয়াইলে এসে দেখি রাস্তার ঢালে পড়ে আছে ৭-৮জনের গলাকাটা লাশ। তাদের কখন মারা হয়েছে কেউ জানেন না। দেহ তখনও কই মাছের মতো নড়ছিল। এ যেন জিন্দা লাশ! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় গিয়ে দেখি একজনের হাতের কব্জি বেরিয়ে এসেছে মাটির ওপরে। তারপরে ছুটে যাই শাঁখারি পট্টিতে। কী নির্মমভাবে ওরা মানুষ পুড়িয়েছে! কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশেই শাঁখারি পট্টির প্রবেশমুখ। সেটি বন্ধ করে আগুন দিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনারা। সবাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েকটি বাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছিল।”
মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সঙ্গে প্রসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক আলোচনায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি না হওয়ায়, ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের মতো ভয়াল রজনী’র জন্ম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ–এর লেখা বই “একাত্তরের মুজিব” থেকে জানা যায় ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাত ১১টায় ঢাকার রাস্তায় সামরিক বাহিনীর কনভয় নামে। সময় যতই পেরোয়, ততই বাড়তে থাকে গোলাগুলির শব্দ। রাত দেড়টার সময় একটি কমান্ডো দল শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে।
এদিকে ২৬ মার্চ রাতে লতিফ খালু বাসায় এসে চুপিচুপি বলেন একটু আগে নাকি হাজী ওসমান গনি রোড থেকে শেখ মুজিবুর রহমান শাড়ী পরিহিত অবস্থায় ঘোড়াগাড়িতে করে অজানার উদ্দেশ্যে পালিয়ে গেছেন।
পরেতো জানলাম সম্পূর্ণ খবরটি ছিলো ভুয়া। এরকম বহু ভুয়া খবর শুনতে শুনতে আমরা ছিলাম দিশেহারা। সম্পূর্ণ ঢাকা শহরটি ছিলো তখন গুজবের শহর। আমাদের তখন কি করা উচিত, তা নিয়ে ছিলাম ভীত, সন্ত্রস্ত, ব্যতিব্যস্ত, অস্থির,উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। মুরুব্বীদের কথায় আমরা কেউ বাহিরেও যেতে পারি না। এমতাবস্থায় আমরা বাসায় থাকতে থাকতে কেমন যেনো হাঁসপাঁস করতেছিলাম। এই গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে এবং নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। তারা নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলকেই হত্যা করে। এই রাতে তারা শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা বাড়িঘর, দোকানপাট ও অন্যান্য স্থাপনাতেও আগুন লাগিয়ে দেয়। এ সংবাদগুলো আমরা বিভিন্ন বিদেশি ও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি। বর্তমানের মতো তথ্য প্রবাহের যুগ না থাকায় তৎকালীন সময়ে আমরা ছিলাম ঘোরতর অন্ধকারে। এমতাবস্থায় কখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের এলাকায় হানা দেয় এই ভয়ে প্রতিদিনই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি নিশ্চুপ, জড়োসড়ো হয়ে। বাবা আরবী, ফার্সি, উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন বিধায় বাড়ির সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্তে দেয়ালে আরবীতে আল্লাহু আকবার, জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ইত্যাদি লিখে দেয়া হলো এবং আমাকে বলা হলো জিন্নাহর ছবি আঁকতে পারবো কি না। আমি বললাম ইনশাআল্লাহ পারবো। যে কথা সেই কাজ। পুরো দেয়াল জুড়ে এঁকে ফেললাম কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি। নিজেদের অন্যত্র সরাবার কোনো ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা না থাকায়, নিরাপদ থাকার উদ্দেশ্যে ছিলো এমন অভিনব ব্যবস্থা। পাক আর্মি পরবর্তীতে কখনো আমাদের গলিতে হানা দিয়েছে বলে শুনিনি। এভাবেই শামসুদ্দিনদের বাসা থেকে লিবারেশন পিরিয়ডে বংশালের হাজী আব্দুল্লাহ সরকার লেনের বাসায় অক্টোবর ১৯৭১ মাস নাগাদ চলে আসি। ১৯৭১ সালের ফেব্র“য়ারি মাস পর্যন্ত স্কুলে ক্লাস হয়েছে। পহেলা মার্চের পর সব ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়।
আমাদের পুরান ঢাকার স্কুল হাম্মাদিয়া হাই স্কুল এপ্রিল/মে নাগাদই খোলা হয়েছিলো বলে আমার ধারণা। দেশের অন্যান্য স্কুল বিভিন্ন কারণে বন্ধ থাকলেও আমাদের স্কুল আদৌ বন্ধ ছিলো বলে আমার কাছে মনে হয়নি। স্কুল থেকে প্রতিদিন বাসায় আসার পথে নয়াবাজার মোড়ে জংলী ক্যাপ পরিহিত পাক আর্মিরা ভয়ংকররূপে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাদের মতো জংলীদের খপ্পরে যেনো না পড়তে হয়, সেজন্য কসাইটুলি হয়ে বিভিন্ন গলি ঘুরে আব্দুল হাদি লেন দিয়ে বংশালের বাসায় আসতাম। আসার পথে বড় ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে ডাঃ আনু ও উনার আরও দু’ একজন বন্ধুর কাছে স্কুলের পরিবেশ, পরিস্থিতি ও অসামঞ্জস্য কোনো কিছু থাকলে তা বিস্তারিতভাবে বলে তারপর বাসায় আসতাম। তাঁরা বংশাল পুকুর পাড়ে হামেদ ব্যাপারীর সুরম্য অট্টালিকার পাকা সিঁড়িতে প্রতিদিনই বসা থাকতো। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের কাজ করতো। এভাবেই আমি ও আমার দু’একজন সহপাঠী মুক্তিযোদ্ধা ডাঃ আনু ও তাঁর বন্ধুদের সাহায্য করেছি, বিজয় দিবসের আগের দিন পর্যন্ত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৫টা ২৫ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আÍসমর্পণ করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি তার পাঁচ ডিভিশন সেনা নিয়ে। এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা শহরের পথে-পথে আকাশের দিকে তাক করে রাইফেলের ফাঁকা গুলিতে প্রকম্পিত করে তোলেন ‘জয় বাংলা’ সহ বিভিন্ন শ্লোগানে। সন্ধ্যার পর থেকেই থমথমে ঢাকা নগরী তখন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্ত হয়ে সবাই আজ আনন্দে মাতোয়ারা। যেনো স্বর্গীয় মোহনীয়তার পরশে আজ সবাইত।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর(বৃহস্পতিবার) ও ১৭ ডিসেম্বর (শুক্রবার) পুরান ঢাকায় যা দেখেছিঃ
* ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, ভারতীয় ও বাংলাদেশী বাহিনীর যুগ্ম কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আÍসমর্পণ করেন। আমি এই বিরল ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করি।
* এরমধ্যে দেখেছি ১৭ ডিসেম্বর, শুক্রবার শাঁখারী বাজারের ময়লা-আবর্জনার মধ্যে একটি কুকুর, মানুষের মৃতদেহ থেকে নাড়ি-ভূড়ি টেনে বের করে খাচ্ছে।
* বর্তমানে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিসের পশ্চিমে এবং বঙ্গবাজারের অপরদিকে কাজী আলাউদ্দিন রোডের ‘কেন্দ্রীয় পশু হাসপাতালের সম্মুখে মানুষ সমান গর্ত করে একটি পাকিস্তানি সমর্থক রাজাকারকে তার অমানবিক কর্মকান্ডের জন্য সেই গর্তে ঢুকিয়ে ইট, পাথর ও লাথি মারার দৃশ্য।
* বংশাল-মালিটোলার পুলের উপরে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের একটি গরু চালিত ময়লার গাড়িতে মালিটোলার গেদু গুন্ডাকে বিকৃত ভাবে মেরে মুখে একটি সিগারেট মুখে দিয়ে চোখ দু’টো উপড়ে ফেলে পুরান ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় প্রদক্ষিণ করানো। এই লোক নাকি পাক আর্মিদের সহযোগিতায় এলাকার লোকদের এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি।
* নারিন্দায় চাচার বাড়ি থেকে ফেরার পথে এলাকার দু’তিনজন লোক, একজন রাজাকারকে এক টুকরো পাউরুটি জোর করে খাওয়াবার চেষ্টা করে বলছে জীবনের শেষ খাবার খেয়ে নে। শুনেছি এই লোক নাকি যুদ্ধকালীন নয় মাসে এলাকার বহু লোকের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের কারণ ছিলো।
* এক পাকিস্তানি যুবককে এলাকার ছেলেরা
ধরে এনে বংশাল মিল্লাত ক্লাবের তিনতলায় বেধরক মার দেয়, আর বলে গান গাইতে পারোছ। পাকিস্তানি যুবকটি বললো, “হাঁ, মেঁ থোড়া থোড়া জানতা হুঁ।” গান শেষ হয়, আবার মার শুরু হয়, এভাবেই যুবকটির উপর সারারাত ব্যাপী চলেছে নির্যাতন। নির্যাতনের শেষ পরিণতি কি হয়েছিলো, তা দেখার মতো সবল চিত্ত আমার ছিলোনা বিধায় বাসায় চলে আসি। এরকম টুকরো টুকরো ঘটনাবলী দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত হয়েছে।
প্রাণখোলা আনন্দের মাঝেও অসংখ্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হƒদয়ে ছিলো আপন-জন হারাবার এক বিষাদ বেদনার প্রতিচ্ছবি।
১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাত্রির ভয়াবহ যাত্রা জেনারেল নিয়াজি’র আÍসমর্পণের মধ্য দিয়েই শেষ হয়। সমস্ত ঘটনা হƒদয়ের অভ্যন্তরে গ্রথিত হয়ে থাকবে অনন্তকাল।
আমার কচি মনে গেঁথে থাকা পঁচিশ মার্চ কালরাত্রি সহ তৎপরবর্তী নয়মাসের নির্মম ঘটনা সম্বলিত দৃশ্যগুলি কোনদিনও মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
এ দিনে যাদেরকে আমরা হারিয়েছি, তাদের সকলকে রাব্বুল আলামিন বেহেশতের সর্বোচ্চ মাকাম জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক, আমিন।
লেখক: কর্মকর্তা (অবঃ), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি)। anwaraftab611@gmail.com