ভবনের পর ভবনের ধ্বংসযজ্ঞ। ওপর থেকে দেখলে মনে হয়, ভূমিকম্পে ধ্বংস হওয়া আস্ত একটা শহর। যেখানে নিঃশ্বাস ফেলতে হয় দালান-কোঠার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। যেখানে খাদ্যের অভাবে মরছে মানুষ। অপুষ্টিতে কংকালসার শিশুদের দেহ। বিশুদ্ধ পানি নেই। টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। শীত নিবারণের কাপড় নেই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কেটেছে দিনের পর দিন। এর মধ্যেই চলছে বোমাবর্ষণ। লুকানোর জায়গা নেই। এই বোমা কেড়ে নিয়েছে ৪৭ হাজার মানুষের প্রাণ। যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি হামলায় এমনই একটা মৃত্যুপরী ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। অবর্ণনীয় এই ধ্বংসস্তূপের ফাঁকে এখন উঁকি দিচ্ছে নতুন দিনের সূর্য।
দীর্ঘ ১৫ মাস ধরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যে ভয়াবহ বিমান হামলা ও গোলা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায়, অবশেষে তার থেকে নিস্তার পেতে যাচ্ছে এর অধিবাসীরা। সব কিছু ঠিক থাকলে রোববার থেকে শুরু হবে যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি। এর মাধ্যমে মৃত্যু উপত্যকায় একটু স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা মিলবে নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী-শিশুদের। এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী যে তারাই।
দেড় বছরের ধ্বংসলীলা চালানোর পর হাই প্রোফাইল দুই মন্ত্রীর কঠোর বিরোধিতার মধ্যেই ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছে। দেশটির উচ্চ-স্তরের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা শুক্রবার বিকালে এই চুক্তি অনুমোদনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চুক্তিটি এখন আলোচনা ও ভোটের জন্য পূর্ণ মন্ত্রিসভায় চলে যাবে। আগামী রোববার থেকে যুদ্ধবিরতি শুরু হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয়। মধ্যস্থতাকারীদের দ্বারা ঘোষিত চুক্তিটি রোববার দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। হিব্রু মিডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম তিন নারী জিম্মিকে বিকাল ৪টায় মুক্তি দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে ঢুকে হামলার চালানোর পরদিন থেকে থেকে প্রতিশোধ নিতে শুরু হয় যেই অসম যুদ্ধ, তাতে অবরুদ্ধ উপত্যকাটির প্রায় প্রতিটি পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। নির্বংশ হয়ে গেছে অনেক পরিবার। অর্থাৎ এসব পরিবারের আর কোনো সদস্য জীবিত নেই। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ঘর-বাড়ি, স্কুল-হাসপাতাল এবং রাস্তা-ঘাটসহ নানা অবকাঠামোর যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গাজায় ইসরায়েলি হামলা প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ হাজার ৮৭৬ জন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজার ৬৪২ জন। এদের মধ্যে অনেকে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছেন। যুদ্ধবিরতি শুরুর ঘোষণার মধ্যেও থেমে নেই ইসরায়েলি হামলা। সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮৮ জন। আহত হয়েছেন ১৮৯ জন।
যুদ্ধের তীব্রতা গাজার ঘনবসতিপূর্ণ নগর এলাকাকে সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের উপাত্ত সংগ্রহ করে ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র তুলে ধরে বলছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১ লাখ ৭০ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় গাজার ৩৬টির মধ্যে ১৮টি হাসপাতাল আংশিকভাবে কার্যকর রয়েছে, যার মোট ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮০০ বেড। আর ইউনিসেফ বলছে, গাজার ৪৯৬টি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা মোট স্কুলের ৮৮ শতাংশ। এর মধ্যে ৩৯৬টি সরাসরি হামলায় বিধ্বস্ত।
অন্যদিকে জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার ১০৩ বর্গকিলোমিটার কৃষিজমি ধ্বংস হয়েছে, যা মোট কৃষিজমির ৬৮ শতাংশ। রাস্তাঘাটের ৬৮ শতাংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ হাজার ১৯০ কিলোমিটার রাস্তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে এবং ৪১৫ কিলোমিটার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমেরিকা, মিসর, কাতারের প্রচেষ্টায় যুদ্ধবিরতির চুক্তি যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন শুরু হয়, তাহলে তা গাজাবাসীর জন্য স্বস্তি নিয়ে আসবে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান অস্থিতিশীলতাও কমে আসতে পারে। কারণ এই যুদ্ধ ঘিরেই লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাকের প্রতিরোধ অক্ষের গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। গাজা উপত্যকায় এখন একটা নির্মল সুন্দর দিনের অপেক্ষা। যেদিনের পর থেকে পেছনের দুঃসহ স্মৃতিগুলো ভুলে ঘুরে দাঁড়াবে গত ৭৫ বছর ধরে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিরা।