ইসকনের নেতা চিন্ময় দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। দেশের বাইরে প্রতিবেশী এবং বন্ধু প্রতীম দেশ ভারতের কোথাও কোথাও চলছে আন্দোলন। এ নিয়ে আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং কলকতায় বাংলাদেশ হাই কমিশন অফিসে হামলা,ভাঙ্গচুরের ঘটনা ঘটনায় একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক। একই সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে ফেলা হয়। তাছাড়া সিলেট সীমান্তে ভারতের বেশ কিছু লোক বাংলাদেশে অবৈধ প্রবেশের চেষ্টা চালায়। এ নিয়ে অবশ্য তাৎক্ষণিক ভারত বিবৃতি দিয়ে দু:খ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় তার এক বক্তব্যে বাংলাদেশে ইসকন ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট নিরসনে জাতিসংঘের শান্তি মিশন পাঠানোর জন্য চিঠি দিতে কেন্দ্র সরকার তথা নরেন্দ্র মোদী সরকারকে আহ্বান জানান। ২রা ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় দেওয়া বক্তৃতায় মমতা বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে সংখ্যালঘুরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন, সেসব অঞ্চলে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের জন্য জাতিসংঘের দ্বারস্থ হতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বিধানসভায় দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘‘প্রয়োজনে সেখানকার (অন্তবর্তীকালীন) সরকারের সঙ্গে কথা বলে তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশে পাঠানো হোক।’ মূলত: মমতা বন্দোপাধ্যায়ের এই আহ্বানে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে অঝাচিত হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কূটনৈতিক মহল। কারণ জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী শুধুমাত্র কোন দেশ নিজেরা চাইলে বহি:শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজেদের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা জাতি সংঘের কাছে সৈন্য চাইলে তা জাতিসংঘ দিতে পারে এবং দিয়ে থাকে। কাজেই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীই যথেষ্ট সক্ষম নিজের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘরে শান্তি রক্ষি মোতায়েনের প্রশ্ন অবান্তর। এদিকে, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্টদের দাবি, চিন্ময় এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সুস্পষ্ট এবং যথাযথ তদন্তের মাধ্যমেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সরকার সঠিক পথে আছেন বলে মত নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ধর্মীয় প্রচারণার আড়ালে সমাজে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন। তার কর্মকান্ড দেশের অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত ছিল। তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, তার সংযোগ রয়েছে কিছু ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে, যা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির অংশ। অন্যদিকে ইসকন নেতৃবৃন্দ বলছেন, চিন্ময় দাসকে অন্যায়ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তাদের দাবি, তিনি সবসময় শান্তি ও মানবতার বানী প্রচার করে এসেছেন এবং এ ঘটনায় তার কোনো হাত নেই। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই ঘটনা শুধুমাত্র ব্যক্তি বা সংগঠন কেন্দ্রিক নয়। এটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছে। তাদের ধারণা, চিন্ময় দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে একটি মহল পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে, যা দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সরকারি সূত্র বলছে, চিন্ময় দাসের গ্রেফতার কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা ধর্মকে লক্ষ্য করে নয়। এটি আইনশৃঙ্খলার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে সরকার কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, কেউ এই ইস্যু নিয়ে উস্কানিমূলক কর্মকান্ড চালালে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে। বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য, এই ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি। রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন, এবং নাগরিক সমাজকে মিলিতভাবে কাজ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হবে। চিন্ময় দাসের গ্রেফতার একটি আইনি প্রক্রিয়া, তবে এর প্রতিক্রিয়া যেন অস্থিতিশীলতার জন্ম না দেয়, তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। জাতিসংঘ ও জেনেভায় অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত তারেক মো.আরিফুল ইসলাম এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন তারা চিন্ময় ইস্যুতে বলেন, 'আমরা অত্যন্ত হতাশার সাথে লক্ষ্য করছি যে শ্রী চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারকে কিছু বক্তা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তাকে আসলে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিষয়টি আদালত মাধ্যমে মীমাংসা করা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। গত ১লা ডিসেম্বর এক বার্তায় বলা হয়, বৈশ্বিক মিডিয়া এই ধরনের অনেক প্রোপাগান্ডা নাকচ করে দিয়েছে এবং অন্তর্বতী সরকার সরেজমিন পরিস্থিতি দেখার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত রয়েছে।
২৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার জেনেভায় জাতিসংঘের সংখ্যালঘু ফোরামের ১৭তম অধিবেশনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ বিবৃতি প্রদান করেন। অন্যদিকে গত ৩০ নভেম্বর দেশের চলমান পরিস্থিতে অন্তর্বতী সরকারকে সমর্থন জানিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিলেন ৫০ বিশিষ্ট নাগরিক। গত শনিবার এক যৌথ বিবৃতিতে তারা এ আহ্বান জানান। বিবৃতিতে তারা বলেন, দেশের সামনে এখন জরুরি কাজ হলো রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ তৈরিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন।
বিবৃতিতে বলা হয়, এই প্রেক্ষাপটে পতিত শাসনের শক্তিগুলো তাদের বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের প্রকাশ্য এবং গোপন সমর্থনে দেশে বিভাজন সৃষ্টিতে সক্রিয় রয়েছে। তারা মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার ছড়াচ্ছে এবং সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের অতিরঞ্জিত, বানোয়াট এবং ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা প্রতিবেদন প্রচারের মাধ্যমে একটি সম্মিলিত প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এই প্রপাগান্ডার ফলে ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে সাইফুল ইসলাম নামে একজন সরকারি কৌঁসুলিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, আমরা সব বাংলাদেশিকে, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ, আদর্শ, লিঙ্গ, বয়স বা যে কোনো বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে এই হুমকির মুখে জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আহ্বান জানাই। আমরা বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বরের প্রতি আমাদের সংহতি প্রকাশ করছি।
এমনি অবস্থ্য়া প্রতিবেশী এবং আমাদের বন্ধু প্রতীম দেশ ভারত বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে অঝাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে এমন প্রত্যাশা থাকবে । কারণ চিন্ময় দাসের কর্মকান্ড,শান্তি প্রিয় মানুষকে উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতীশীল করা এবং চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং এ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা কান্ডে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রমণ হওয়ায় তাকে আটক ও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে,সরকারের প্রতি আহ্বান থাকবে চিন্ময় ইস্যুকে পুঁজি করে কেউ যেন সংখ্যালঘুদের উপর হামলা বা তাদের সম্পদ ক্ষতি,লুঠ করতে না পারে সে দিকে সর্তক দৃষ্টি রাখা। বাংলাদেশ একটি সম্প্রীতির দেশ,এখানে যুগ যুগ ধরে হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান,মুসলমান ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করে আসছি। আমাদের মহান মুক্তি যুদ্ধের অন্যতম চেতনা এবং লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা, কারণ হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান,মুসলমানসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি গৌষ্ঠির সম্মিলিত অংশ গ্রহণ,আতবলিদানের মধ্যদিয়েই অর্জিত হয়েছে মহান স্বাধীনতা,আমরা পেলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য অসাম্প্রদায়িক এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের অবিচ্ছেদ্য অভয়ব। কারণ আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান,উৎসব সকলে মিলেই উদযাপন করি। এ জন্য বলা হয়,‘ধর্ম যার যার-উৎসব সবার।’ আশা করছি এই সম্প্রীতি,সৌহার্দ্য আবাহমান কালের ঐতিহ্য সমভাবে বহমান থাকবে খরস্্েরাতা নদীর মতো অনাগত দিনেও । মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক ও সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম। ৪ ঠা ডিসেম্বর,২০২৪ ইং।
মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক,সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।