ঈদ মুসলিম উম্মাহর আনন্দঘন, তাৎপর্যপূর্ণ ও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত একটি দিন। এ দিনে রয়েছে আনন্দ ও খুশির সমারোহ এবং ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ ইবাদত-বন্দেগি ও আবেগের সংমিশ্রণ। অপরদিকে জুমা সপ্তাহের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় দিন। এদিনের রয়েছে উল্লেখযোগ্য তাৎপর্য, বৈশিষ্ট্য এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য। কালের পরিবর্তনে কখনো জুমার দিনে ঈদ অনুষ্ঠিত হয়ে দিনটি হয়ে ওঠে আরো মহিমাময়। জুমার দিনের ঈদে রয়েছে বাড়তি মর্যাদা ও বিধান।
দুই ঈদের সম্মিলন : জুমার দিন হলো সপ্তাহের ঈদের দিন। আর ঈদুল ফিতর ও ঈদুর আযহা হলো বছরের ঈদের দিন। কাজেই জুমার দিন ঈদ অনুষ্ঠিত হলে সাপ্তাহিক ঈদ ও বাৎসরিক ঈদের সম্মিলন ঘটে। এবারের ঈদুল ফিতর জুমার দিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জুমার দিনের ঈদকে রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই ঈদের সম্মিলন বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার দিনের ঈদের খুতবায় বলেছেন, এদিনে তোমাদের জন্য দুটো ঈদের সম্মিলন ঘটেছে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১০৭৫)
ঈদ ও জুমার নামাজের আনুষ্ঠানিকতা : জুমার দিন ঈদ হলে ঈদ ও জুমা উভয়ের আনুষ্ঠানিকতা ভিন্নভাবে আদায় করতে হবে। ঈদের নামায আদায় করা ওয়াজিব আর জুমার নামায আদায় করা ফরয। রাসুল (সা.) এর যুগে জুমার দিন ঈদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে তিনি সকালে ঈদের নামায আদায় করেছেন এরপর জুমার সময় জুমার নামায আদায় করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমরা ইনশাআল্লাহ দুটোই (জুমার দিনে ঈদের ক্ষেত্রে ঈদ ও জুমা) আদায় করবো।’ (ইব্ন মাজাহ, হাদিস : ১৩১১)
জুমার নামাযের অপরিহার্যতা : জুমার দিন জুমার নামায অবশ্যই আদায় করতে হবে। জুমার দিন ঈদ হোক আর যাই হোক। কারণ জুমা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ কোরআনুল কারিমে ‘জুমুয়া’ নামে একটি সুরা অবতীর্ণ করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে- ‘হে মুমিনগন! জুমার দিনে যখন নামাযের জন্য আহবান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটিই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ (সুরা : জুমুয়া, আয়াত : ৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ঈদ ও জুমার নামায আদায় : রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো জুমার নামায ছেড়ে দেননি। তাঁর যুগে জুমার দিন ঈদ অনুষ্ঠিত হলে তিনি ঈদ ও জুমা দুটোই আদায় করেছেন। নুমান ইবনে বশির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) দুই ঈদ ও জুমার নামাজে ‘সাব্বিহিসমা রাব্বিকাল আলা’ (সুরা আলাক) ও ‘হাল আতাকা হাদিসুল গাসিয়া’ (সুরা গাসিয়া) পাঠ করতেন। আর কখনো ঈদ ও জুমা একসাথে হলে তিনি দুটোতেই এই দুই সুরা পাঠ করেন। (মুসলিম, হাদিস : ২০৬৫; তিরমিজি, হাদিস : ৫৩৩)
জুমার নামাজ ঐচ্ছিক নয় : জুমার দিন ঈদ হলেও জুমার নামাজ ঐচ্ছিক হবে না। অপরিহার্যই থাকবে। তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার দিন দূরদূরান্তের অজোপাড়া গাঁয়ে থেকে ঈদের নামায আদায় করতে আসা মানুষদের জন্য জুমা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে চলে যাবার ব্যাপারে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তাদের জন্য ঈদের নামায আদায় করার পর বাড়ি গিয়ে আবার জুমার নামায আদায়ের জন্য আসা অথবা এখানে অবস্থান করে জুমা পর্যন্ত অপেক্ষা করা দুটিই কঠিন ব্যাপার ছিল। যেমন বুখারির বর্ণনায় এসেছে- ‘আবু উবাইদ (রা.) বলেন, আমি উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর সাথে ঈদে উপস্থিত ছিলাম। সেদিন জুমার দিন ছিল। তিনি খুতবার আগে ঈদের নামায পড়ালেন অতঃপর খুতবা দিলেন। তিনি বললেন, হে লোকেরা! আজ তোমাদের জন্য দুটি ঈদের সম্মিলন হয়েছে। গ্রাম্যলোকদের মধ্যে যে ভালো মনে করে সে যেন জুমার নামায আদায়ের জন্য অপেক্ষা করে। (বুখারি, হাদিস : ৫২৫১)
এ হাদিস দ্বারা জুমার দিন ঈদ অনুষ্ঠিত হলে ঈদের নামায ছেড়ে দেয়ার কোন অবকাশ প্রমাণিত হয় না। কারণ, প্রথমত. জুমার বিষয়টি কোরআন ও সুন্নাহর অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। দ্বিতীয়ত. আলোচিত হাদিসে কেবলমাত্র দূরদূরান্তের অজোপাড়া গাঁ থেকে ঈদের নামায আদায় করতে আসা মানুষদের জন্য জুমা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে চলে যাবার ব্যাপারে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এমন গ্রাম্য মানুষের উপর জুমা অপরিহার্যই নয়। (আল-মুসান্নাফ, হাদিস : ৫০৯৮-৯; মুসান্নাফু আব্দির রাজ্জাক, হাদিস : ৫৭১৯; সুনান আল-বায়হাকি আল-কুবরা, হাদিস : ৫৪০৫)
আমাদের দেশের গ্রামসমূহ গ্রামীণ প্রশাসনিক অবকাঠামোতে পরিচালিত হওয়ার ফলে শহরের অন্তর্ভূক্ত। বাংলাদেশের সকল গ্রামে জুমা ও ঈদের নামায আদায় করার পরিবেশ রয়েছে। কাজেই জুমার দিন ঈদ অনুষ্ঠিত হলেও ঈদ ও জুমা উভয় নামায ভিন্নভাবে আদায় করতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ঈদ উদযাপন বিবেকের বোধশক্তি জাগৃত করে ও সমাজে মানুষের মধ্যে মমতাবোধ, দয়া-অনুগ্রহ তৈরি করে। ঈদ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের তৎপরতা এবং ত্যাগের মহিমায় অনুপ্রাণিত হওয়ার সুমহান শিক্ষা। জুমার দিনে ঈদ এ অনুপ্রেরণা আরো বাড়িয়ে দেয়। আল্লাহ সবাইকে বোঝার তৌফিক দান করুন।