ডা. কাকলী হালদার
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি শেষ না হতেই হানা দিয়েছে মাঙ্কিপক্স নামক আরেক রোগ। মাঙ্কিপক্স রোগ মাঙ্কিপক্স (এমপক্স) নামক ভাইরাস সংক্রমণে হয়ে থাকে যা খুবই ছোঁয়াচে। স্মলপক্স (১৯৮০ সালে নির্মূল ঘোষণা করা হয়) আর মাঙ্কিপক্স ভাইরাস সমগোত্রীয় হলে এটি চিকেনপক্স থেকে আলাদা।
তবে চিকেনপক্স আর মাঙ্কিপক্সের রোগলক্ষণ এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে অনেকটাই মিল রয়েছে। এমপক্স প্রধানত প্রাণীদের রোগ হলেও ২০২২ সাল থেকে এটি ব্যাপকভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বছরের শুরু থেকেই মধ্য আফ্রিকার কঙ্গো, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা, কেনিয়ায় এই রোগ থাকলেও গত কয়েক মাসে ইউরোপের অনেক দেশে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। এবার এশিয়ায়ও এমপক্স ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।
হঠাৎ করেই আশঙ্কাজনকভাবে এই ভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ১৪ আগস্ট ২০২৪ সারাবিশ্বে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)। এর আগে ২০২২ সালে প্রথমবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাঙ্কিপক্স নিয়ে সতর্কতা জারি করেছিল।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গিয়েছে প্রায় ৫৩০ জন। ২০২৩ সালের তুলনায় এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্তের হার ২০২৪ সালে ১৬০ শতাংশ বেড়েছে এবং মৃত্যুর হার বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। মাঙ্কিপক্সের মৃত্যুহার বিভিন্ন ঝুঁকির ওপর নির্ভর করে ১-১০ শতাংশ হতে পারে (কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, দীর্ঘমেয়াদি রোগ, বৃদ্ধ এবং শিশু ইত্যাদি)।
নাম মাঙ্কিপক্স হলেও এমপক্স ভাইরাসটি ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, বানর, কাঠবিড়ালি, বন্য কুকুর, সজারু এবং খরগোশের শরীর থেকে সংক্রমিত হতে পারে। তবে সর্বপ্রথম এই ভাইরাস বানরের শরীরে পাওয়া যায়।
রোগ সংক্রমণ কীভাবে হয় ১. সংক্রামিত ব্যক্তির সাথে সরাসরি যেকোনো ধরনের সংস্পর্শ, চুম্বন বা যৌনমিলনের মাধ্যমে। ২. আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, ব্যবহার করা কাপড়, সুচ বা অন্যান্য জিনিসপত্রের মাধ্যমে। ৩. আক্রান্ত প্রাণীর কামড়, আঁচড়, শিকার করা, চামড়া ছাড়ানো, কাটা বা রান্না করার সময়। ৪. আক্রান্ত প্রাণীর মাংস কম তাপমাত্রায় বা কম সময়ে রান্না করে খেলে। ৫. আক্রান্ত গর্ভবতী মায়ের কাছ থেকেও অনাগত শিশু ভাইরাসটি দিয়ে আক্রান্ত হতে পারে। ৬. শরীরের পানিপূর্ণ ফোসকা বা ব্লিস্টার সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। ৭. আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়ার এক থেকে চার দিন আগে থেকেই অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারে।
রোগের উপসর্গ- এমপক্স জীবাণু দিয়ে সংক্রমিত হওয়ার সাধারণত তিন থেকে ২১ দিনের মধ্যে উপসর্গ শুরু হয় এবং সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। তবে বয়স্ক, শিশু, ক্যানসার বা এইডস আক্রান্ত রোগী এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের উপসর্গ দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং রোগের তীব্রতাও বেশি হতে পারে।
এই রোগের লক্ষণগুলো সাধারণত শুরু হয় জ্বর, গলাব্যাথা, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা দিয়ে। এরপর লিম্ফ নোড বা লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া, দুর্বলতা, হাঁচি-কাশি এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানের ত্বকে জলভর্তি ফোসকা বা ব্লিস্টার হয়। ব্লিস্টার শুকিয়ে স্ক্যাব বা স্তর পড়ে যায় যা আস্তে আস্তে শুকিয়ে ঝরে পড়ে।
তবে এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হলে বা কম সংখ্যক জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হলে অনেক ক্ষেত্রে তিনি উপসর্গবিহীন থাকতে পারেন। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথমেই ফোসকা দিয়েও রোগের লক্ষণ শুরু হতে পারে যা প্রথম দিকে সমান এবং লাল থাকলেও আস্তে আস্তে পানি ভর্তি হয়ে যায়। হাতের তালু, পায়ের পাতা, হাত, পা, বুক, মুখ, লিঙ্গ, অণ্ডকোষ, কুচকি, যোনির পাশে এবং মলদ্বারে এ ধরনের ফোসকা বেশি দেখা যায়।
ফোসকায় ব্যথা এবং চুলকানি হয়ে থাকে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং সঠিক চিকিৎসা না পেলে এসব ফোসকায় সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে। চিকিৎসা- এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে অবশ্যই আলাদা রুমে বা হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারে ক্ষত না শুকানো পর্যন্ত রাখতে হবে যেন অন্য কেউ আক্রান্ত না হয়। যেহেতু আমাদের দেশে এখনো এই রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি তাই এমন উপসর্গের রোগী পেলে সাথে সাথে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।
এই রোগের কোনো সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। সাধারণত রোগের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা, পুষ্টিকর সুষম খাবার এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে পারলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শে জ্বর, গলাব্যাথা, মাথাব্যথা এবং পেশি ব্যথা কমানোর জন্য ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।
কখনো কখনো রোগের তীব্রতা বেশি হলে এবং জটিলতা এড়াতে অ্যান্টিভাইরাল (টেকোভিরিম্যাট, সিডোফোবির) এবং অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পরামর্শও দেওয়া হয়।
রোগ পরবর্তী জটিলতা- সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না হলে এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন রোগী হলে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত, বিকৃত দাগ, ফোসকায় সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন, ব্রঙ্কোপনিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, সেপটিসেমিয়া, মেনিনজাইটিস, এনকেফালাইটিস ইত্যাদি হতে পারে।
রোগ প্রতিরোধে করণীয়- ১. আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই আলাদা রুমে বা হাসপাতালে আইসোলেশনে রাখতে হবে। রোগীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। ব্যবহার করা কাপড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র স্পর্শ করা যাবে না। ২. স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিচর্যাকারীকে রোগীর কাছে যেতে অবশ্যই গ্লাভস, মাস্ক এবং এপ্রোন পরতে হবে। ৩. রোগীর থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। ৪. কোনো কিছু স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে খাবার খাওয়া বা মুখে হাত দেওয়া যাবে না। ৫. সাবান পানি দিয়ে সঠিক নিয়মে ৩০-৪০ সেকেন্ড এবং অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে ২০-৩০ সেকেন্ড হাত ধুতে হবে। ৬. আক্রান্ত ব্যক্তিকে ঘরের বাইরে মাস্ক এবং হাত পা ঢাকা কাপড় পরতে হবে। ৭. আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। সংস্পর্শে আসলে দ্রুত সাবান পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন। ৮. যেকোনো প্রাণীর মাংস সঠিক তাপমাত্রায় এবং সঠিক সময় ধরে রান্না করে খেতে হবে। ৯. যদি রোগের লক্ষণ দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ১০. বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন-রোগ সংক্রমণের হার বেশি এরকম কয়েকটি দেশে এবং যাদের রিস্ক বেশি তাদের স্মলপক্সের ভ্যাক্সিন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া ইতোমধ্যে যারা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন কিন্তু রোগের লক্ষণ এখনো প্রকাশ হয়নি তাদের টিকা দেওয়া যাবে। এমপক্সের বিরুদ্ধে এই টিকা ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে সক্ষম। বাংলাদেশে এখনো এই রোগে আক্রান্ত কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। তবে পাকিস্তানে তিন জন ব্যক্তির দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। কোনো ব্যক্তির শরীরে এরকম কোনো রোগের লক্ষ্মণ দেখা দিলে, বিদেশে থাকাকালীন আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অথবা সংক্রমিত কোনো দেশ ভ্রমণের ২১ দিনের মধ্যে এই লক্ষ্মণ দেখা দিলে ১৬২৬৩ এবং ১০৬৫৫ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
তবে শুধুমাত্র বিমান পথেই না সড়কপথ, নৌপথ এবং সব বর্ডারগুলোয় সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এসব পথেও আক্রান্ত রোগী দেশে প্রবেশ করতে পারে। এ ছাড়া রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, মাইকিং, পোস্টার এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে আহ্বান জানাতে হবে। যেহেতু রোগটি নতুন তাই ভয় না পেয়ে বা আতঙ্কিত না হয়ে রোগটি সম্পর্কে সবাইকে সঠিক তথ্য জানানো, সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ।