দেশে গত কয়েক বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়েছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করাই যখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ, ঠিক সে সময় সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞে অস্থির পুরো দেশ। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে। নতুন করে চোখ রাঙাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, শাকসবজি, মাছ-মাংসের দাম নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে।
এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, চলমান অনিশ্চয়তা উচ্চ মূল্যস্ফীতি তথা অর্থনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি করেছে। কেননা জিনিসপত্রের দাম বাড়লে কিংবা উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর সরাসরি পড়ে। তাদের সংসার চালানোর খরচ বাড়ে।
চলমান সহিংস ঘটনায় দেশের নিত্যপণ্যের সরবরাহব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল। ফলে রাজধানীর বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকে।
কারফিউ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়। দুই দিন ধরে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা সচল হতে শুরু করেছে। ফলে রাজধানীর বাজারে পণ্যের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দামও কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো দুই সপ্তাহ আগের অবস্থায় ফিরে আসেনি।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ অস্বাভাবিক চাপে পড়েছে।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতির জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। একদিকে সবকিছু বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাজ নেই; অন্যদিকে বাজারে জিনিসপত্রের বাড়তি দাম। দিনমজুর শ্রেণির মানুষের দু-তিন দিনের সঞ্চয়ও থাকে না। তাই জিনিসপত্রের বাড়তি দাম উচ্চ মূল্যস্ফীতির যে নতুন সংকট চলছে, তা আরো বাড়িয়ে দিলো।
বাজারে যেমন প্রভাব পড়েছে-
সম্প্রতি সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রাজধানীতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এতে বাজারে চাল, ব্রয়লার মুরগি, মুরগির ডিম, মাছ-মাংস, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। তবে গত দুই দিনে শাকসবজির দাম কিছুটা কমেছে।
খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা বলছেন, বাজার এখনো গরম। দাম এখনো আগের পর্যায়ে আসেনি।
চাল ছাড়াও অন্য নিত্যসামগ্রী যেমন চিনি, পেঁয়াজ, ব্রয়লার মুরগি, মুরগির ডিমের দাম কিছুটা বেড়েছে। গতকাল ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ১৩৫-১৪০ টাকায়। মাত্র দুই দিন আগে চিনির দর কেজিতে ৫-১০ টাকা কম ছিল।
বাজারে এখন ১১০-১২০ টাকা কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ভারত থেকে আমদানি বাড়লেও পেঁয়াজের দাম কমার কোনো সুখবর নেই।
প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি এখন ১৯০ টাকা, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ১৭০ টাকা। ফার্মের মুরগির বাদামি ডিমের দামও ডজনে ১০-২০ টাকা বেড়ে এখন ১৫০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গত দুই দিনে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় সবজির সরবরাহ বেড়েছে। ফলে কমতে শুরু করেছে সবজির দাম। বেশির ভাগ সবজির দাম এখন ১০০ টাকার নিচে বিক্রি হচ্ছে।
তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সবজির এই দাম এখনো তুলনামূলক অনেক বেশি। মৌসুমের এই সময়ে দাম আরো কম থাকার কথা ছিল।
এদিকে মাছের বাজারেও প্রভাব পড়েছে। গত কয়েক দিনে সরবরাহ কম থাকায় মাছের দাম বাড়তি আছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ রুই, তেলাপিয়া, পাঙাশ ও চিংড়ি মাছ বেশি খায়। এসব মাছের দাম স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কেজিতে ২০-৪০ টাকা বাড়তি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকলে দামও নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি আছে, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষ অস্বস্তিতে রয়েছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তথা আয় বৃদ্ধির দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তবে গত কয়েক দিনে স্থবির হওয়া সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করে দ্রুততম সময়ে স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সাধারণ মানুষ গত এক যুগের মধ্যে চলতি বছর সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। যে হারে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় বাড়ছে না। আয়ের চেয়ে খরচের গতি বেশি হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে অন্তত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। অন্যদিকে জাতীয় মজুরি হার বৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো। এক বছর ধরেই খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় ছিল। গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। গত বছরের আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে উঠেছিল, যা অর্থবছরের সর্বোচ্চ।
গত অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার লক্ষ্য থাকলেও এর ধারেকাছে নেই।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে সরেজমিন পরিদর্শন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম। এ সময় তিনি বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে পণ্যের দাম ও সরবরাহের খোঁজ নেন। বাজার পরিদর্শন শেষে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, এত ধ্বংসযজ্ঞের পরও দ্রুততম সময়ে পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা স্বাভাবিক করা হয়েছে। পাইকারি বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি নেই। এসব পণ্য খুচরা বাজারে গেলে সেখানেও যৌক্তিকভাবে দামও কমে আসবে।
তিনি আরো জানান, বিশেষ করে কারফিউর মধ্যেও পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচের মতো পচনশীল পণ্যের সরবরাহে যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে, সে জন্য সরকার কাজ করছে। ফলে সরবরাহ নিয়ে কোনো সংকট তৈরি হবে না বলে আশা করেন তিনি।
এদিকে বিপাকে পড়েছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর কার্ডধারী সুবিধাভোগী এক কোটি পরিবার।
টিসিবি থেকে দেশের এক কোটি পরিবারের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হয়। নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে পরিবেশকেরা পুরো কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অ্যাপস সচল করা সম্ভব হচ্ছে না। তিন-চার দিন ধরে সুবিধাভোগীদের কাছে এসব পণ্য সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে বাইরের বাজার থেকে বেশি দামে পণ্য কিনেছেন টিসিবির কার্ডধারী অনেক ভোক্তা।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গত কয়েক দিনের সহিংস ঘটনা অর্থনীতির জন্য বড় ক্ষতি হয়ে গেল। মানুষের মধ্যে একধরনের শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। এখনো ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্যের চলাচল ঠিক করতে পারছি না। নিরাপত্তা জোরদার করে এখন পণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল ঠিক করতে হবে। গরিব পরিবারের জন্য বিশেষ সহায়তা ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।