চিকিৎসকদের আন্দোলনে নিজের ক্ষমতা যখন টালমাটাল অবস্থা তখন এই আন্দোলনে রাশ টানতে ভিন্ন কৌশল নিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। চিকিৎসকদের সঙ্গে কয়েক দফা বসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে নিজেই পদত্যাগ করতে পারেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দাবি আদায়ে অনড় চিকিৎসকরাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন আন্দোলন। এর মধ্যেই শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) আচমকা চিকিৎসকদের আন্দোলন মঞ্চে হাজির মমতা বন্দোপাধ্যায়। সেখানে গিয়ে বললেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নন, চিকিৎসকদের দিদি হিসেবে তিনি এই মঞ্চে এসেছেন। দিলেন সব দাবি আদায়ের ঘোষণাও।
আনন্দবাজার অনলাইনের খবরে বলা হয়, শনিবার দুপুরে কলকাতার সল্টলেকে স্বাস্থ্য ভবনে আচমকা গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। তাদের সঙ্গে দেখা করেন মমতা। ছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারও। ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চের সামনে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠকের মাধ্যমে তাদের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার নিরাপত্তাজনিত নানা নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি নিজে ছুটে এসেছি। আপনাদের আন্দোলনকে কুর্নিশ জানাচ্ছি। আমি আপনাদের ব্যথা বুঝি। আমিও ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে এসেছি।
শুক্রবার রাত থেকে কলকাতায় বৃষ্টি চলছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, নিম্নচাপের কারণে শনিবার দিনভর ঝড়বৃষ্টি হবে। আবহাওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মমতা। তিনি বলেন, শুক্রবার সারা রাত ঝড়জল হয়েছে। আপনারা যেভাবে বসে আছেন, আমার কষ্ট হচ্ছে। গত ৩৪ দিন ধরে আমিও রাতের পর রাত ঘুমোইনি। কারণ, আপনারা রাস্তায় থাকলে আমাকেও পাহারাদার হিসাবে জেগে থাকতে হয়।
আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো সরকার বিবেচনা করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, যদি আপনারা কাজে ফিরতে চান, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের দাবিগুলো সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করব। আমি একা সরকার চালাই না। মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, ডিজি সকলের সঙ্গে আমি আপনাদের দাবি নিয়ে আলোচনা করব। যদি কেউ দোষী হন, শাস্তি পাবেন। সিবিআইকে অনুরোধ করব, দ্রুত তদন্ত শেষ করুন। দোষীদের ফাঁসি হোক। কেউ দোষী থাকলে আমি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেব। এটুকু বলতেই আমি এসেছি।
সব মেডিক্যাল কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতি ভেঙে নতুন করে তৈরি করা হবে, জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ডাক্তারদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা আমাদের ঘরের ভাইবোন। আমি কোনো অবিচার হতে দেব না। সব হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতি নতুন করে তৈরি করা হবে। তাতে জুনিয়র ডাক্তার, সিনিয়র ডাক্তার, নার্স, পুলিশ সকলের প্রতিনিধি থাকবে। আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরজি করের রোগী কল্যাণ সমিতি আমি ভেঙে দিলাম। নতুন করে তা তৈরি করা হবে।’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, যদি সত্যি কেউ দোষী হয়, তারা শাস্তি পাবে। কেউ আমার বন্ধু বা শত্রু নয়। যাদের আমার বন্ধু বলছেন, আমি তাদের চিনিই না। প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা এসেছেন। আমি সাধ্যমতো পদক্ষেপের চেষ্টা করব। আপনারা কাজে ফিরুন। আমি আপনাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ করব না।
মমতা আশ্বাস দেন, রাজ্য সরকার ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ করবে না। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা চলছে। কোনো পদক্ষেপ আপনাদের বিরুদ্ধে করা হবে না। এখন আমি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এখানে আসিনি। আন্দোলনের সমব্যথী হিসেবে এসেছি। আপনাদের বড় দিদি হয়ে এসেছি। আমাকে সময় দিন। ভালো থাকুন। ধর্নামঞ্চে আন্দোলনকারীদের যা খাবার দেওয়া হচ্ছে, নির্বিচারে তা না খাওয়ার অনুরোধ করেন মমতা। তিনি বলেন, আপনাদের কাছে আসা মানে নিজেকে ছোট করা নয়। বড় করা। এটা আমার শেষ চেষ্টা। যে যা দিচ্ছে, খেয়ে নেবেন না।
শনিবার মমতা পৌঁছানোর পরেও ধর্নাস্থল থেকে বিচারের দাবিতে স্লোগান ওঠে। বেশ কয়েক মিনিট মাইক হাতেই দাঁড়িয়ে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী। ধর্নাস্থলে খানিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। তার পর ডাক্তারদের উদ্দেশে বার্তা দেন মমতা। এর আগে জুনিয়র ডাক্তারেরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার তাদের প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠানো হয়েছিল নবান্নে। ৩২ জন সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু বৈঠক ভেস্তে যায়। ডাক্তারেরা বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার দাবি করেছিলেন। কিন্তু সরকার তাতে রাজি হয়নি। সে দিন নবান্নের সভাঘরে দুই ঘণ্টার বেশি সময় বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরে তিনি বেরিয়ে যান। সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা জানান, সুপ্রিম কোর্টে এই সংক্রান্ত মামলা বিচারাধীন থাকায় সরাসরি সম্প্রচার সম্ভব নয়। এদিকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আচমকা আন্দোলন মঞ্চে হাজির হয়ে যাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈঠকে বসেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সরকারের আশ্বাসে তারা আন্দোলন থেকে আপাতত সরে দাঁড়াতে পারেন।